অনলাইন সীমান্তবাণী ডেস্ক : সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ‘জাল টাকা প্রতারকচক্র বিরোধী পোস্ট’ নামে একটি পেজ পরিচালনা করতো সদ্য কৈশোর পাড়ি দেওয়া মো. মাউন হোসেন সাব্বির (২১)। এই পেজের বিভিন্ন পোস্টে কমেন্টের সূত্র ধরেই পরিচয় হয় আরও কয়েকজনের সঙ্গে। এক পর্যায়ে তারা শুরু করে জাল টাকার ব্যবসা। অবশ্য শেষ রক্ষা হয়নি, চক্রটির ৪ সদস্যকে গ্রেফতার করেছে র্যাব।
সংস্থাটি জানিয়েছে, সদ্য কৈশোর পেরোনো এই চার তরুণ ইউটিউব এবং ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে এই ধরনের জাল টাকা তৈরি ও ব্যবসার প্রতি তারা আকৃষ্ট হয়। তাদের গ্রেফতারের সময় প্রায় ১ কোটি টাকার সম মূল্যের জাল নোট, একটি ল্যাপটপ, একটি প্রিন্টার, একটি পেনড্রাইভ, এন্টি কাটার একটি, টাকার পাঞ্চিং এক রোল, জিলেটিং ৫০০ গ্রাম, প্রিন্টারে ব্যবহৃত কালির খালি বোতল ১২টি, গালা ৫০০ গ্রাম, স্পিরিট ৬ বোতল ও ফেবিকল আঠার ছয়টি বোতলসহ জালনোট তৈরির বিপুল পরিমাণ সরঞ্জামাদি জব্দ করা হয়েছে।
সাব্বির ছাড়াও গ্রেফতার অন্য তিনজন হলো- মো. পারভেজ (২০), মো. তারেক (২০) ও মো. শিহাব উদ্দিন (২০)।
রবিবার (২২ অক্টোবর) দুপুরে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে র্যাবের মিডিয়া সেন্টারে বাহিনীর মুখপাত্র খন্দকার আল মঈন এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেফতারকৃতরা জানিয়েছে, তারা পরস্পর যোগসাজশে প্রায় এক বছর ধরে ঢাকা, সিরাজগঞ্জ, খুলনা ও যশোরসহ বিভিন্ন এলাকায় জাল নোট তৈরি করে স্বল্পমূল্যে বিক্রি করতো। এছাড়াও এ চক্রের সদস্যরা নিজেরাও বিভিন্ন মোবাইল ব্যাংকিং দোকান, মাছের আড়ৎসহ জনসমাগমপূর্ণ এলাকায় জাল নোট ব্যবহার করতো।’ এ চক্রটির অন্যতম হোতা গ্রেফতারকৃত মাউন হোসেন সাব্বির এবং এই চক্রের সাথে আরও ১৫-২০ জন সদস্য জড়িত রয়েছে বলে জানিয়েছে র্যাব।
কম সময়ে অল্প পুঁজিতে ধনী হওয়ার লোভে কিছু তরুণ এই প্রতারণার আশ্রয় গ্রহণ করে জানিয়ে খন্দকার আল মঈন বলেন, ‘সাব্বির প্রথমে জাল নোটের খুচরা ব্যবসা করার জন্য পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিল। ফেসবুকে অন্য একটি জাল নোট তৈরির চক্রের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। চক্রটির কাছ থেকে সে ৩ লাখ টাকার জাল নোট কেনার জন্য মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে এক ব্যক্তিকে ৩৫ হাজার টাকাও পাঠায় সে। টাকা পাঠালেও চক্রটি তাকে কোনও জাল নোট দেয়নি। সেখানে না পেয়ে নিজেই জাল নোট তৈরির জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়।
পরিকল্পনার অংশ হিসেবে তারা প্রথমে মেসেঞ্জারে এক্স-ম্যান নামে একটি গ্রুপ খুলে জাল টাকা তৈরি-ব্যবসার বিষয়ে তথ্য আদান-প্রদান করতে থাকে। এই গ্রুপের অ্যাডমিন হিসেবে শিহাব কাজ করতো। শিহাবের মাধ্যমে গ্রেফতারকৃত অপর দুই সদস্য পারভেজ এবং তারেক এর সাথে তার পরিচয় হয়।
পরবর্তী সময়ে সে ইউটিউব, ফেসবুক এবং গুগল ঘেটে জাল নোট তৈরির বিভিন্ন বিষয়ে কারিগরি জ্ঞান অর্জন করে এবং বিভিন্ন সময়ে জমানো অর্থ দিয়ে জাল নোট তৈরির জন্য ল্যাপটপ, প্রিন্টার, প্রিন্টিং ডাইস, পেনড্রাইভ, কাগজ, টিস্যু পেপার ও প্রিন্টারের কালিসহ অন্যান্য সরঞ্জামাদি ক্রয় করতো।
এই র্যাব কর্মকর্তা জানান, গ্রেফতারকৃত সাব্বির জালনোট তৈরির সার্বিক বিষয়ে দক্ষ হওয়ায় সবকিছু সে নিজেই পরিচালনা করতো। যখন জাল নোটের ব্যবসা রমরমা থাকে, তখন চক্রটি দৈনিক ২ লক্ষাধিক টাকা মূল্যমানের জাল নোট তৈরি করত। মূলত তারা একটি অভিনব কায়দায় জাল নোটগুলো বিক্রয় করত। তারা তাদের আগের ফেসবুক গ্রুপ ‘‘জাল টাকা প্রতারক চক্র বিরোধী পোস্ট’’ থেকে কমেন্টস দেখে তাদের সাথে ম্যাসেঞ্জারে চ্যাটিং এর মাধ্যমে ক্লাইন্ট তৈরি করে জাল টাকার ব্যবসা করতো। পরবর্তী সময়ে দেশের বিভিন্ন জায়গায় চক্রের সদস্যেদের মাধ্যমে ঢাকাসহ সিরাজগঞ্জ, খুলনা, যশোর এলাকায় সরবরাহ করতো। তারা কখনও সরাসরি জাল নোটগুলো ক্লায়েন্টকে দেখাতো না।
গ্রেফতারকৃত সাব্বির বগুড়া থেকে উচ্চ মাধ্যমিক শেষ করে ২০১৯ সালের শেষের দিকে ঢাকায় এসে মিটফোর্ডে তার দূর সম্পর্কের মামার ওষুধের দোকানে কর্মচারী হিসেবে কাজ করতো। পাশাপাশি অনার্স ১ম বর্ষে ভর্তি হয়েছে। সে তার নিজ পেশার আড়ালে জাল নোট তৈরির অন্যতম হোতা হিসেবে প্রায় এক বছর ধরে চক্রটি পরিচালনা করছিল।
আর গ্রেফতারকৃত শিহাব স্থানীয় একটি কলেজে ডিগ্রী প্রথম বর্ষে অধ্যয়নরত। ফেসবুকেই সাব্বিরের সঙ্গে পরিচয় হয় তার। সে ইউটিউব দেখে জাল নোট প্রিন্ট করার ধারণা নেয়। চক্রটিতে সে জাল টাকা প্রিন্টিং, কাটিং এবং বান্ডিলিংসহ প্যাকিংয়ের কাজ করতো।
গ্রেফতারকৃত মো. পারভেজ ফেসবুকের বিভিন্ন পেজ ও গ্রুপে জাল নোট ব্যবসার সংবাদ দেখে জাল টাকার ব্যবসার প্রতি আকৃষ্ট হয়। পরবর্তী সময়ে শিহাবের মাধ্যমে সাব্বিরের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। সেও ইউটিউবে ভিডিও দেখে জাল টাকা তৈরি করা সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করে। চক্রটিতে সে কম্পিউটারে গ্রাফিক্সের মাধ্যমে জাল নোট তৈরি এবং প্রিন্টিং এর কাজ করতো সে।
শিহাবের মাধ্যমেই সাব্বিরের সঙ্গে পরিচয় হয় গ্রেফতারকৃত আরেক তরুণ তারেকেরও। সে স্থানীয় বাজার থেকে জাল নোট তৈরির প্রয়োজনীয় উপকরণ ক্রয় করতো।
গ্রেফতারকৃত আসামিদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন বলেও জানান র্যাবের এই কর্মকর্তা।
Leave a Reply